লেখা: banglatainment ডেস্ক
গত দশক ধরে বিনোদন জগতে সবচেয়ে বড় রূপান্তর এনে দিয়েছে OTT (Over-The-Top) প্ল্যাটফর্মের আগমন। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, ডিজনি প্লাস, হুলু, হটস্টারসহ বহু ডিজিটাল স্ট্রিমিং সার্ভিস বিশ্বব্যাপী সিনেমা ও টেলিভিশন কন্টেন্টের উৎপাদন, বিতরণ ও ভেবেচিন্তার গতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারও এর বাইরে নয়। এই আর্টিকেলে আমরা বিশ্লেষণ করবো কীভাবে OTT প্ল্যাটফর্ম সিনেমা শিল্পের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারা পরিবর্তন করছে, এবং এর ফলে নির্মাতা, প্রযোজক ও দর্শকের অভিজ্ঞতা কেমন বদলেছে।
পরম্পরাগত সিনেমা উৎপাদনে বড় বড় স্টুডিও ও প্রযোজক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ছিল। বিনিয়োগ, বিষয়বস্তু নির্বাচন, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং প্রচারের সিদ্ধান্তগুলো মূলত সীমিত একটি সার্কেলের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতো। কিন্তু OTT প্ল্যাটফর্মগুলো সেই নিয়ন্ত্রণকে ধাক্কা দিয়ে দিয়েছে। তারা এমন অনেক স্বাধীন নির্মাতা ও নতুন গল্পের সন্ধান করছে, যা প্রচলিত মুল্যবোধ ও বাজারের বাইরে।
OTT প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মিত কন্টেন্টের বিষয়বস্তু সাধারণত বহুমাত্রিক ও বৈচিত্র্যময়। যেমন লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, সামাজিক শ্রেণি, মানসিক স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুকে এগিয়ে আনা হচ্ছে। এটি বিশেষ করে ছোট ছোট ভাষার সিনেমা ও সিরিজ নির্মাতাদের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অনেকে আজকেও বলে থাকেন, “OTT প্ল্যাটফর্মগুলো বিশ্বব্যাপী গল্প বলার একটি নতুন ভাষা সৃষ্টি করেছে।”
পূর্বে সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের কেবল সিনেমা হল বা টেলিভিশন চ্যানেলের উপর নির্ভর করতে হতো। এর ফলে বহু ভালো সিনেমা সীমিত আঞ্চলিক দর্শকের মধ্যেই আটকে থাকতো। কিন্তু OTT প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষ ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে সিনেমা দেখতে পারছে। এতে কন্টেন্টের প্রাপ্যতা সীমাহীন ও সময়নির্বাচন সম্পূর্ণ দর্শকের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
বাংলাদেশেও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহার ও স্মার্টফোনের সংখ্যার কারণে OTT কন্টেন্টের জনপ্রিয়তা। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘বিঙ্গ ওয়াচিং’ (একটানা অনেক এপিসোড দেখা) একটি নতুন চলতি ফ্যাশন। এর ফলে নির্মাতা ও প্রযোজকরা দর্শকের সময়সূচী ও পছন্দের উপর ভিত্তি করে সিনেমা ও সিরিজ তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছেন।
OTT প্ল্যাটফর্ম মূলত সাবস্ক্রিপশন (Subscription), অ্যাডভর্টাইজমেন্ট (Advertisement), ও পে-পার-ভিউ (Pay-Per-View) মডেল অনুসরণ করে। এর ফলে সিনেমা ও সিরিজ নির্মাতারা প্রচলিত সিনেমা হলের বিক্রির বাইরে আরও বিক্রয়-প্রচারের পথ পেয়েছে। যেমন, কোনো সিনেমা থিয়েটারে প্রদর্শিত না হওয়ায় বা খুব সীমিত হলে OTT প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেলে, সেটি বিশ্বব্যাপী দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারে।
এছাড়া, মাল্টিপ্লেক্স বা থিয়েটার মালিকপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা বা বিতর্কের আশঙ্কা নেই। এক্ষেত্রে নির্মাতারা বেশি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা অনুভব করছেন।
OTT প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দর্শকের হাতে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ চলে আসা। তারা যেকোন সময়, যেকোন ডিভাইসে, যেকোন ভাষায় পছন্দের সিনেমা দেখতে পারে। সাবটাইটেল ও ডাবিং সুবিধার কারণে স্থানীয় সিনেমাও বিদেশী দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে।
তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। অফলাইনে সিনেমা দেখার সামাজিক অভিজ্ঞতা কমে গেছে, থিয়েটারের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দর্শকরা। এছাড়া, অনেক OTT কন্টেন্টের অতিরিক্ত বর্ধিত সময়কাল এবং সিরিজের সংখ্যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে তুলছে।
বাংলাদেশেও নব্বই দশকের পর থেকে প্রথাগত টেলিভিশন চ্যানেল ও সিনেমাহল কেন্দ্রিক বিনোদন দেখে আসছে। কিন্তু ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে নেটফ্লিক্স, আইটিউন্সসহ আন্তর্জাতিক OTT প্ল্যাটফর্মের আগমন ও বাংলাভাষী নতুন OTT সাইট যেমন ‘Hoichoi’, ‘Bongo’, ‘Chorki’ বাংলাদেশের বিনোদন জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
দেশের অনেক নির্মাতা OTT প্ল্যাটফর্মে বিশেষ সিরিজ ও ছোট মুভি নির্মাণ করে নিজেদের কাজের পরিধি বাড়াচ্ছেন। এছাড়া, দর্শকরা সহজেই বাংলা, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার আন্তর্জাতিক কন্টেন্ট অ্যাক্সেস করছে। এটি কেবল বিনোদনের ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে।
OTT প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে। ইন্টারনেট সংযোগ আরও দ্রুত ও সাশ্রয়ী হবে, নতুন প্রযুক্তি যেমন ৫জি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) ইত্যাদি OTT কন্টেন্টের কাস্টমাইজেশন ও প্রোডাকশনে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
তবে নিয়মনীতি, কপিরাইট, কন্টেন্টের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং সমতাভিত্তিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ থাকবে।
OTT প্ল্যাটফর্মের উত্থান বিশ্বব্যাপী সিনেমার উৎপাদন ও বিতরণ পদ্ধতিকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে। এটি চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্যের দরজা খুলেছে, দর্শকদের জন্য আরও সহজ ও ব্যক্তিগতকৃত বিনোদন নিয়ে এসেছে, এবং ব্যবসায়িক মডেলে নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে এই পরিবর্তন বিনোদন শিল্পকে গতিশীল, উদ্ভাবনী ও বহুমাত্রিক করে তুলছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবার সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।