১৪ বছর হলো সেই দিনটির, যখন ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় একটি মাইক্রোবাস এবং বিপরীতমুখী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আজও মনে হয়, তারেক মাসুদ এর চোখের জোনাকি আলো, গল্প বলার ভঙ্গি, চলচ্চিত্রের প্রতি অদম্য প্রেম আমাদের সঙ্গে বেঁচে আছে।
“আমি ভালো-মন্দ সিনেমা দেখিনি। পথের পাঁচালী আমাকে শিখিয়েছে—একটি ছবি কীভাবে জীবনের কাছাকাছি আসতে পারে।” — তারেক মাসুদ
‘মাটির ময়না’ – স্মৃতির ফ্রেম

২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মাটির ময়না’ শুধু বাংলাদেশের প্রথম অস্কার মনোনীত চলচ্চিত্রই নয়, এটি তারেক মাসুদ এর স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। ১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক উত্তেজনা, তার শৈশবের নীরব পর্যবেক্ষণ—সব মিলিয়ে ছবির প্রতিটি দৃশ্য যেন একটি জীবন্ত ইতিহাস।
“যদি পাখি ডাকে, তার পাখা ভেঙে যায়—তবু সে আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখে। ঠিক তেমনি মানুষও।”
ক্যাথরিন মাসুদের প্রযোজনায় এবং সহ-চিত্রনাট্যে ‘মাটির ময়না’ আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে। ফিপরেস্কি পুরস্কার জয় এবং অস্কারের জন্য মনোনয়ন, এই সব অর্জন শুধু পুরস্কার নয়—এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক পরিসরে তারেক মাসুদ
তারেক মাসুদ শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না; তিনি একটি আন্দোলন, একটি ভাবনার প্রতীক। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম ও দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক শর্ট-ডকুমেন্টারি উৎসবের মাধ্যমে তিনি তরুণ নির্মাতাদের পথ দেখিয়েছেন। তারেকের চোখে প্রতিটি দৃশ্য ছিল জীবনের অংশ, প্রতিটি সংলাপের মধ্যে লুকানো ছিল মানবিক প্রশ্ন।
“চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়; এটি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করার একটি উপায়। যদি দর্শক হয় অনুধাবন করতে, সেই মুহূর্তটাই সবচেয়ে বড় জয়।”
ক্যাথরিন মাসুদ – সঙ্গী ও সহযাত্রী
ক্যাথরিন মাসুদ শুধু সহধর্মিণী নয়; তিনি তারেক মাসুদ এর চিন্তার সহচর। যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো এই নারী বাংলাদেশে এসে তারেকের সঙ্গে ‘অডিওভিশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। একযোগে বহু শর্ট, ডকুমেন্টারি ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ, আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচার—সবকিছুই তারেকের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তারেকের প্রয়াণের পরও তিনি তার কাজ সংরক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে তার স্মৃতি জীবন্ত রেখেছেন।

স্মরণ ও প্রতিফলন
আজ, ১৪ বছর পরও, তারেক মাসুদ এর সিনেমা আমাদের মনে প্রশ্ন তুলে: নীরবতা কি শুধু অনুপস্থিতি, নাকি কথার চেয়ে গভীর? ‘মাটির ময়না’, ‘অন্তরযাত্রা’, ‘রানওয়ে’, প্রতিটি চলচ্চিত্র যেন তার আত্মার প্রতিবিম্ব।
“চলচ্চিত্রের পর্দা যদি চুপচাপ থাকে, তবে চোখের ভাষা শোনো—সেই নিঃশ্বাসেই লুকিয়ে আছে গল্প।”
চলচ্চিত্র কর্মী ও স্মরণ
- মিশুক মুনীর – প্রধান চিত্রগ্রাহক, আন্তর্জাতিক ভিডিওগ্রাহক
- প্রসূন রহমান – নির্মাতা, তারেক মাসুদ সম্পর্কিত ডকুমেন্টারি নির্মাতা
- নাহিদ মাসুদ – চলচ্চিত্র বিশ্লেষক, স্মৃতিচারণে অংশগ্রহণ
- আসিফ মুনীর – স্মৃতিচারণে অংশগ্রহণকারী
ফিল্ম | প্রকাশন/অর্জন | বিশেষত্ব |
---|---|---|
মাটির ময়না | ২০০২, ফিপরেস্কি পুরস্কার, অস্কার মনোনয়ন | বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরিচিত করা, রাজনৈতিক ও সামাজিক গল্প |
অন্তরযাত্রা | ২০০৬ | মানবিক দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত প্রতিফলন |
রানওয়ে | ২০১০ | সাহসী সিনেমাটোগ্রাফি, সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা |
আদম সুরত | ১৯৮৯ | চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান বিষয়ে তথ্যচিত্র |
আজও তারেক মাসুদ এর স্মরণে চলচ্চিত্র প্রেমীদের মনে এক নীরব প্রার্থনা আছে—প্রদীপ প্রজ্বলন, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, এবং শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে সংলাপ। তার চলচ্চিত্র আজও জীবন্ত, নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা।
Sources: বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল রেকর্ড, গণমাধ্যম প্রতিবেদন ও প্রামাণ্যচিত্র তথ্য।