You might also like

আজম খান

আজম খান | জন্ম: ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০ | মৃত্যু: ৫ জুন ২০১১ | ছবি: সংগৃহীত

আজম খান: Gun ফেলে গান ধরেছিলেন যিনি

১৯৭২। কমলাপুর, ঢাকা।

টাওয়ার হোটেলের দোতলাটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন। ইমিডিয়েটলি ছাদ ঢালাই হবে এমন এক পরিস্থিতি। আজম, নিলু, মনসুর, সাদেক ও এলাকার বন্ধু ফিরোজ সাঁই আড্ডায় বসেছে। এদের মধ্যে আজম সদ্য মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরেছে৷ দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন আজম, বিশেষ করে তার নেতৃত্বে অপারেশন তিতাসের ঘটনাটা ‘সিনেমার’ গল্পকেও হার মানায়। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই স্টাইলিশ যুবক সে- বাবরি চুল, চাপ দাড়ি, বেলবডম প্যান্ট, ফ্যাসনেবল সানগ্লাস, তার উপর দেখতেও সুদর্শন, সব মিলিয়ে কমলাপুরে আজমের ইমেজ রুপকথার নায়কের মত। যদিও আজম এসব খুব একটা পাত্তা দেয় না। এই মূহুর্তে তার প্রধান চিন্তা হল তার দল ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর হারানো ইজ্জত পুনরুদ্ধার করা। ডিআইটিতে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ২৬ জন মিলে একটা প্রোগ্রাম করেছিলো, প্রোগ্রাম সুপার ফ্লপ হয়েছে। ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ইজ্জত নিয়ে টানাটানি অবস্থা। আজম বিষয়টিকে ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নিলো। দলের সদস্যদের বললো,

তরা য্যামনে হউক আর একটা প্রোগ্রাম নে…আমি দ্যাকতাছি কি করা যায়…”

যুবক বয়সের স্টাইলিশ লুকের আজম খান – বাংলার রক সঙ্গীতের কিংবদন্তি

যুবক বয়সের স্টাইলিশ লুকের আজম খান – বাংলার পপ সঙ্গীতের কিংবদন্তি

আজম ভাবতে লাগলেন কি করা যায়; কি এমন ঘটানো যায় যাতে সবার টাসকি লেগে যাবে! ভাবতে ভাবতে একটা অন্যরকম আইডিয়া এলো,  সারা বিশ্বেই তো পপের সুবাতাস বইছে, বিটলস-শ্যাডোজ-রোলিংস্টোনসের জয়জয়কার। বাংলায় পপ গাইলে কেমন হয়? স্বাধীন বাংলায় পপ হবে বাংলায়- আইডিয়া নিয়ে উঠে পরে লাগলো আজম। দিনরাত প্র্যাকটিস-আড্ডা-প্র্যাকটিস। এদিকে দল থেকে জানালো ডিআইটি থেকে প্রোগ্রামের ডেট দিয়েছে। প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্ট এ্যারেঞ্জ করা হল। তবলাবাদক সাদেককে দেয়া হল ড্রামারের দায়িত্ব। শুরু হল প্র্যাকটিস। তখনও ব্যান্ড ফর্ম করার ভাবনা নেই কারও মাথায়, যাস্ট প্রোগ্রামটা মাতিয়ে দিতে হবে। আজম কোন ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে জানে না, কিন্তু তার মিউজিক সেন্স ঈশ্বরপ্রদত্ত। ফলে কোথায় কি বাজাতে হবে তা সে জানে। এক বিন্দু তালছুট হওয়ার উপায় নেই। সাদেক ভয়ে ভয়ে ড্রাম বাজায়। আজমকে সে জমের মত ভয় পায়।

অতঃপর ডিআইটিতে প্রোগ্রামের দিন এল। আজম, বাল্যবন্ধু ফিরোজ সাঁই, নিলু, মনসুর, সাদেক স্টেজে উঠলো বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বাংলা ভাষার পপ কম্পোজিশন নিয়ে। অপমানের জ্বালা বুকে নিয়ে আজম ও তার দল গাইলো

‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ এবং ‘সাক্ষি দেবে চার কলেমা’।

প্রচারের পর ফলাফল হল অভাবিত। চারদিকে হইচই পরে গেল- একি, এমন বাদ্যযন্ত্রে এমন অভূতপূর্ব গায়কীতে বাংলা গান হতে পারে!!! আর গানের কথাও তো কেমন যেন! এমন কথায় গান হয়! প্রেম নাই, বিরহ নাই, সখি নাই, প্রেয়শী নাই- এতো একদম নতুন কিছু!!

আজম খান ও তার বন্ধু মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে স্টেজ শো – রক সংগীতের স্মরণীয় মুহূর্ত

আজম খান ও তার বন্ধু মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে স্টেজ শো – রক সংগীতের স্মরণীয় মুহূর্ত

ডিআইটির প্রোগ্রামের দ্বিমুখী প্রভাব পরলো সরাসরি আজম খানের উপর, তার দলের উপর  নয়। একদিকে দেশব্যাপী সাধারণ শ্রোতারা নতুনত্বের স্বাদে নড়েচড়ে বসলো, অপরদিকে দেশের ইন্টেলেকচুয়ালরা কপাল কুঁচকে বলতে লাগলো, হায় হায় একি হচ্ছে! দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে দুর্যোগের ঘনঘটা!

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ঢাকার যুব সমাজ তখন বিভ্রান্ত। রীতিমতো অবক্ষয় চলছে। নেশা-ছিনতাই-রাহাজানি শুরু হয়েছে। আজম ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবলো,

“এটাই যদি হবে তাহলে যুদ্ধ করলাম কেন?”

চিন্তিত হয়ে পড়ল আজম। রাত দিন ভাবতে লাগলো কি করা যায়, কি উপায়ে যুব সমাজের মনযোগ সঠিক পথে আনা যায়, আধুনিক জীবনে উদ্বুদ্ধ করা যায় তাদের।  মনে হল, যুদ্ধ শেষ হয় নি, আরও একটা যুদ্ধ প্রয়োজন। যুব সমাজকে অবক্ষয় থেকে বাঁচানোর যুদ্ধ। যেহেতু আজম গান জানে, এবারের যুদ্ধে গানই হবে তার অস্ত্র। এসব নিয়ে আড্ডা হচ্ছে, আচমকা আড্ডায় স্কুল ড্রেস পরা এক কিশোরী এসে হাজির। মেয়েটি আজমের পরিচিত। তাদের বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকে। নাম পাপড়ি। মেয়েটি অসম্ভব রুপবতি। আজম স্নেহের হাসি মুখে নিয়ে প্যান্টের পেছন ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটি আনত দৃষ্টিতে ইতস্তত স্বরে বললো, মহল্লার বখাটেরা তাকে ‘ত্যাক্ত’ করে। শুনে আজম প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো। তখনই বখাটেদের ধরে এনে এক চোট রাম প্যাদানি সহ কান ধরে ওঠবস করালো। এরপর মহল্লার কেউ আর পাপড়ি দিকে চোখ তুলে তাকাতো না। সেই থেকে পাপড়ির ‘ভালোমন্দ’ দেখা রুটিন দায়িত্ব হয়ে গেল আজমের।

যুদ্ধের পর তখন দেশের ফুটবল কেবল জাগতে শুরু করেছে। আজম ভালো ফুলবল খেলতো। ফুটবল ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাথে তার ভালো যোগাযোগ। মন চাইলেই ফুটবল নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু ইদানিং আজমকে আর মাঠে পাওয়াই যায় না বলতে গেলে। ঢাকার কিছু ক্লাব থেকে লোক আসে তাকে নিতে, আজম তখন টাওয়ার হোটেলে মিউজিক আড্ডা আর যুব সমাজকে অনুপ্রাণিত করার পরিকল্পনায় বুদ। ফুটবলে দেয়ার মত সময় নেই তার। এসব নিয়ে পাপড়ির সাথে তার কথা হয়, পাপড়িকে কেন যেন সে আর ইদানীং এলাকার ছোট বোন হিসেবে দেখতে পারে না, একটু বেশি কিছু মনে হয়। আগে কথা না শুনলে ধমক-ধামক দিতো, এখন তাও দিতে পারে না। উল্টা পাপড়ির সামনে গেলে নিজেরই বুক কাঁপে ইদানীং। কি সমস্যা কে জানে!!!

আজম খান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়

আজম খান বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়

এর মধ্যেই একদিন ফিরোজ সাঁই আজমের কাছে নিয়ে এলো গান পাগল এক যুবককে। ঢাকার সংগীত মহলে যুবকের আলাদা পরিচিতি আছে, ইংলিশ পপ গানে তার তুমুল জনপ্রিয়তা। আজম বাংলা পপ গায় শুনে যুবক দেখা করতে এসেছে। প্রথম দেখায়ই যুবককে মনে ধরে আজমের। তার মতই আধুনিক, স্টাইলিশ। এবং সদা হাস্যমুখি। যুবক নিজেই আজমের দিকে হাত বাড়িয়ে হাসিমুখে বললো, হ্যালো…আমি ফেরদৌস ওয়াহিদ। আজম লাজুক হেসে বললো,

“আমি মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। লোকে আজম খান কয়।”

মনের মিল হওয়ায় প্রথম দিনই দুজনের তুমুল বন্ধুত্ব হয়ে গেল, কেননা ফেরদৌস ওয়াহিদও ইংলিশ ছেড়ে বাংলা ভাষায় গাইতে চাইতো, কিন্তু দলের ভেটো থাকায় পারছিলো না। সে দিন থেকেই দুই বন্ধু শুরু করে বাংলা গান রেকর্ডের পরিকল্পনা।

রেকর্ডের পরিকল্পনা করে আজম একই সাথে উত্তেজিত এবং অস্থির বোধ করতে লাগলো- রেকর্ড তো করবে ঠিক আছে, কিন্তু কি রেকর্ড করবে? গানই তো নাই। দুটা গান ছিলো, তা তো ডিআইটির প্রোগ্রামে করা হয়ে গেছে। আজমের অস্থিরতা দেখে পাপড়ি ভরসা দেয়, মৃদু স্বরে বলে, আপনে পারবেন। আজম অবাক হয়, কি পারার কথা কইতাছো! পাপড়ি বলে,


“নতুন গান বানাইতে পারবেন আপনি…”


বলেই সিড়ি দিয়ে দৌড়ে বাসায় উঠে যায় পাপড়ি। আজমের মনে হয়, যেন রঙিন একটা প্রজাপতি এই মাত্র উড়ে গেল।

সময়টা ভর দুপুর। টাওয়ার হোটেলের আন্ডারকনস্ট্রাকশন ফ্লোরের এক জায়গায় আজম তার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আজমের একটাই চিন্তা, গান বানাইতে হবে। আজমের টেনশন দেখে নিলু পানির ট্যাংকির ঢাকনাকে ড্রামস বানিয়ে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বাজাতে শুরু করে। সাদেক সহ অন্যরাও যার যার মত তাল উঠায় হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে। দেখতে দেখতে মত্ততা ভর করে। তালে তালে আজম আচমকা গেয়ে ওঠে, 

‘ওরে সালেকা
ওরে মালেকা-
ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে…।


এই দেড় লাইনের উপরই জ্যামিং চলে দেড় ঘন্টা। ওখানেই সৃষ্টি হতে থাকে কালজয়ী গানটি। আজম যন্ত্র বাজাতে পারে না, কিন্তু কোথায় কি বাজাতে হবে তার নির্দেশনা দেয়। দেখতে দেখতে পুরো গানটা তৈরী হয়ে যায়।

আজমের নতুন গান শুনে পাপড়ির চোখ কপালে ওঠে, ওমা এ কেমন গান!!! আজমের মেজাজ খারাপ হয়, কেমন গান আবার কি! ভালো না খারাপ হেইডা কও…
পাপড়ি বলে, বুঝতেছি না তো…সালেকা মালেকা বিষয়টা কি?
আজম বলে, কোন বিষয় নাই…এই মনে করো এমনেই এমনেই…
পাপড়ি কিছু না বুঝেই বলে, ও আচ্ছা বুঝছি…

স্টেজ শোতে আজম খান

হাইকোর্টের মাজার থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠেছে আজম। ভাড়া দিতে গিয়ে দেখে পকেট কাটা গেছে তার। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার, মাজারেও পকেট মার! কষ্টে আনমনেই গেয়ে ওঠে, 

হাইকোর্টের মাজারে, 
কত ফকির আছে, 
আসল ফকির কয়জনা…

পরদিনের আড্ডায় যথারীতি ট্যাংকির ঢাকনায় তাল তুলে এটাকেই গান বানানো হয়। তারপর ফেরদৌস ওয়াহিদ আজম আরও দুই বন্ধু শামীম ও রুমি মিলে ইন্দিরা রোডে ঢাকা রেকর্ডিং স্টুডিওতে শিফট ভাড়া করে দুজনের মোট চারটা গান রেকর্ড করা হয়। আজমের সালেকা মালেকা ও হাইকোর্টের মাজার। ফেরদৌস ওয়াহিদের চাঁদ জাগে তারা জাগে ও দুনিয়াটা কত মজার। গানে মুগ্ধ হয়ে স্টুডিও মালিক নিজ উদ্যোগে আজমের গান দুটার রেকর্ড প্রথমে রিলিজ দেয়, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। রাতারাতি ক্রেজ হয়ে যায় আজম।

অতঃপর ব্যান্ড গঠন এখন সময়ের দাবী হয়ে পরেছে। সময়ের সন্তান আজম সময়ের এই দাবীও রাখলো। বন্ধু ফিরোজ সাঁই, মনসুর, সাদেক, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নিলুকে নিয়ে বসলো কি হতে পারে ব্যান্ডের নাম। বিভিন্ন জনে বিভিন্ন নাম বললো, একজন বললো নাম হোক উচ্চারণ। নামটা মনে ধরলো আজমের।

উচ্চারণ ব্যান্ডের আকাশচুম্বি ক্রেজ। একই সাথে ইন্টেলেকচুয়ালদের তির্যক মন্তব্যের সাথে শুরু হয় তৎকালীন মিউজিশিয়ানসদের ইর্ষার গুটিবাজি। কিছু মিউজিশিয়ানরা নাক সিটকানোর পাশাপাশি প্রকাশ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শুরু করলো। এর মধ্যেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কনসার্টে স্টেজে উঠলো ব্যান্ড উচ্চারণ। সময়টা ১ এপ্রিল, ১৯৭৩। স্টেজে উঠে আজম অবাক, কিরে এত মানুষ কইত্যে আইলো! এদিকে উত্তাল শ্রোতা গান শুনতে চায়। গান শুরু হল। একটা গান শেষ হতেই সাগরের গর্জনের মত ‘ওয়ান্স মোর’ ধ্বনি আসে। একে একে চারটা গানই গাইলো ব্যান্ড উচ্চারণ, কিন্তু পাবলিকের ওয়ান্স মোর থামে না। এদিকে গান তো আর নাই। আয়োজক হারুন সাহেব এসে ভয়ে ভয়ে আজমের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ওস্তাদ পাবলিকে তো ওয়ান্স মোর কইতাছে। আজম বিরক্ত মুখে বলে, ওয়ান্স মোর আর কইত্যে পামু… গানই তো চাইরটা… আইজকার মত প্যাক আপ।

পাপড়ি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মানুষটাকে নিয়া এত হইচই হওয়ার কারন কি? তার গানতো পাপড়ির ভালো লাগে না, এমনকি এসব আদৌ গান কি না সে ব্যাপারেই সন্দেহ আছে তার। তবে গান ভালো না লাগলেও গায়ক মানুষটাকে ভীষণ ভালো লাগে তার। তাকে নিয়ে এত হইচই, এত আলোড়ন, দিনভর তার বাসার সামনে অগণন ভক্তের ভীড়- এসবই তার ভালো লাগে। কেন যেন গর্বও হয় তার। গর্ব হয় ভেবে লজ্জাও হয় তার- সব মিলিয়ে কি একটা অবস্থা! বাসার সামনে অপেক্ষারত ভক্তদের যখন অটোগ্রাফ দেয় আজম, পাপড়ি তখন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে।

উচ্চারণ ব্যান্ডের আকাশচুম্বি ক্রেজ

উচ্চারণ ব্যান্ডের আকাশচুম্বি ক্রেজ

উচ্চারণ ব্যান্ডে নতুন গিটারিস্ট এসেছে। নাম রকেট। প্র্যাকটিস প্যাডে, অর্থাৎ টাওয়ার হোটেলের দোতলায় নতুন গান কি করা যায় সে বিষয়ে আড্ডা হচ্ছে, রকেট আচমকা আজমকে গুরু বলে ডাকতে শুরু করে। প্রথম এক-দু বার আজম লক্ষ করে নি হয়তো, কিন্তু দলের অন্যরাও ডাকতে শুরু করলে আজম বিরক্ত হয়, কি কইতাছো এডি! আজম ভাই কও। নয়তো গরু কও…। আজমের আপত্তি টেকে না, দেখা যায় ফেরদৌস ওয়াহিদ ছাড়া সবাই তাকে গুরু ডাকতে শুরু করেছে। বিরক্ত হয়ে উঠে যায় আজম।

বানের জলের মত কনসার্টের অফার আসতে শুরু করেছে। অগ্রীম টাকা পয়সা দিয়ে হলেও পাবলিক শো নিতে চাচ্ছে, অথচ গানেরই সংকট, চার পাঁচটা গান দিয়ে কি প্রোগ্রাম হয়! মহল্লার আড্ডায় হঠাৎ আজমের মাথায় একটা আইডিয়া আসে, আজম প্রায়ই গান গেয়ে বন্ধু বান্ধবকে ক্ষ্যাপাতো। আজমের দুই বন্ধু ছিলো শাহজাহান ও জাহাঙ্গীর, আজমের আর এক বন্ধু আলমগীর এই দুজনকে আলাল দুলাল বলে ক্ষ্যাপাতো। আরও মজা করে ক্ষ্যাপানোর জন্য আজম আলাল দুলাল নামে গান বানাইছিলো, গানে আলাল দুলালের বাবার একটা কাল্পনিক নাম দিয়ে তিনি যে পুলের উপর থেকে সাইকেলে এক প্যাডেল মেরে বাসার দরজায় এসে থামেন, সে বিষয়টিকে যুক্ত করে গানটাকে আরও মচমচা করা হয়। বলাবাহুল্য, গান শুনে বাস্তবের আলাল দুলাল আজম আর আলমগীরকে দৌড়ানি দিতো। এটাকেই এখন পূর্ণাঙ্গ গান করা হবে। শুরু হল প্র্যাকটিস। গানের একটা লাইন ছিলো এমন, ‘তাদের বাবা হাজি চান প্যাডেল মেরে ঐ পুলে পৌঁছে বাড়ি’, আজম ভাবলেন ‘ঐ পুল’ বিষয়টার সাথে পাবলিক রিলেট করতে পারবে না, এখানে কোন একটা পুলের নাম দিতে হবে। লিরিক নিয়ে আজম গেলেন তার ভাই আলম খানের কাছে। আলম খান বললেন, চাংখার পুল দে।

বাংলার প্রথম রক লেজেন্ড আজম

বাংলার প্রথম রক লেজেন্ড আজম খান

বাকিটা ইতিহাস। আলাল ও দুলাল দেশের ইতিহাসে প্রথম ভাইরাল সং। এদিকে চাংখার পুলের ধনাঢ্য ডেকরেটর ব্যবসায়ী হাজি চান সাহেব ভেবে বসলেন, গানটা আজম তাকে নিয়েই গেয়েছে। তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে আজমকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু আজমকে কি আর পাওয়া যায়! পেলেন আজমের বন্ধু আলমগীরকে। বললেন, আজম তো গানডা জব্বর গাইছে, অরে লইয়া একদিন মহল্লায় আহো।

দাওয়াত পেয়ে পুরা লাইন আপ সহ চাংখার পুলে গিয়ে আজম থ হয়ে গেল। গোটা চাংখারপুল এসে জড়ো হয়েছে হাজি চান সাহেবের বাসার সামনে। আজম খানকে দেখে পাবলিক আবেগে আত্মহারা হয়ে তার দিকে ছুটতে শুরু করলো, কারও কোন হুঁশ নাই। হাজি চান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কিয়ামত লাইগা গেলো নিহি…এলা তো পুলিছ আনোন লাগবো!!! হাজি চান সাহেব থানায় ফোন করে ওসিকে বললেন, বিরাট দিগদারি লাইগা গেছে গা আমার বাছার ছামনে, জলদি আহেন মিয়া। ওসি বললেন, আসতেছি…কিন্তু ঘটনা কি হাজি সাহেব? হাজি সাহেব বললেন, আরে আজমে আইছে যে…হালায় পাবলিক মানান যাইতাছে না, আহেন জলদি…

পুলিশ আসলে আজম হাজি সাহেবের বাসায় ঢুকতে পারে। খাওয়া দাওয়ার পর বাসার সামনে বসে গানের আসর। সেটাও এক ইতিহাস। মানুষ যে যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে গান শুনেছে। উচ্চারণ ব্যান্ড সেদিন তাদের সবগুলো গানই গেয়েছিলো।

আনন্দের পরেই আসে বেদনা। আজমের জীবনেও আচমকা এক আঘাত আসলো, এমন আঘাত যার তাৎক্ষণিক কোন চিকিৎসা নেই। আজম শুনলো পাপড়ির বাবার বদলি হয়েছে, তারা চলে যাবে নতুন ঠিকানায়। এই ঘটনা শোনার পর থেকে পাপড়িরও আর দেখা পায় না আজম। পরে জানলো, নতুন এলাকায় পাপড়ির ছোট খালারাও থাকে, তাই পাপড়িকে আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এর পর থেকেই কটা দিন বিষণ্ণ কাটে। এক রাতে মনের কষ্টে গেয়ে ওঠে,

সারারাত জেগে জেগে,
কত কথা আমি ভাবি,
পাপড়ি কেন বোঝে না…

পাপড়ি কেন বোঝে না-আজম খান

সারারাত জেগে জেগে, কত কথা আমি ভাবি, পাপড়ি কেন বোঝে না - বাংলার রক কিংবদন্তি

১৯৭৪ সাল।

পাপড়ির দুঃখ ভুলে যেতে বাধ্য হয় আজম। কেননা আরও বড়, আরও বিস্তৃত দুঃখ এসে আঘাত করেছে গোটা জাতিকে। দেশে শুরু হয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। চারদিকে হাহাকার। খাবারের অভাবে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। গ্রাম থেকে শ্রোতের মত মানুষ আসছে ঢাকায়। কমলাপুর থেকে নটরডেম কলেজ পর্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের করুণ কোলাহলে একাকার। মা নিজের সন্তানকে বেঁচে দেয়ার মত বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। নিজ হাতে স্বাধীন করা দেশের মানুষের এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগে আজম বিচলিত হয়ে পরে। অর্থ খ্যাতি গান বাজনা সবকিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে। সারাদিন রাস্তায় ঘোরে, যাকে যতটুকু পারে সাহায্য করে। শো থেকে অর্জিত টাকা সব দিয়ে দেয় পথের শিশুদের। আজম, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ একদিন কমলাপুর স্টেশনে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো মানুষের দুর্ভোগ। হঠাৎ শিশু বাচ্চা কোলে কান্নারত এক মা’কে দেখে আজম তৎক্ষনাত গেয়ে ওঠে,

‘রেল লাইনের ঐ বস্তিতে,
জন্মেছিলো একটি ছেলে
মা তার কাঁদে, ছেলে কি মরে গেছে।
বাংলাদেশ…

অগনন ভক্তের ‘গুরু…গুরু’ চিৎকারের মধ্যে স্টেজে ওঠে আজম খান। স্টেজের একদম সামনে এসে দাড়ায়। উদ্বেলিত জনতার দিকে হাতের ইশারা করে, শান্ত হও। সবাই শান্ত হতেই গুরু গেয়ে ওঠেন, রেল লাইনের বস্তিতে…। মুহূর্তেই অশান্ত হয়ে ওঠে জনতা, এ যেন এক অশান্ত জনসমুদ্র৷ সমুদ্রের ভেতর দ্বীপের মত দেখা যায় শুধু একজনকে, তিনি আমাদের প্রথম সুপার স্টার, প্রথম রকস্টার আজম খান।

তথ্যসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, আরটিভি, দেশ টিভি সহ অন্যান্য পাবলিক ডোমেইনে প্রচারিত আজম খানের সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য।

Facebook
X
WhatsApp
Email

Related Posts

No Content Available