
হাসপাতালের বেডে বাবা, পাশে বিশ্বখ্যাত লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ রেলা স্যার ও আমি।

MBBS (DU)
জীবন কখনো সরল রেখায় চলে না, হঠাৎ করেই মোড় নেয়, আর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ২০১৯ সালের এক সাধারণ জুলাই মাস, আমি তখন কুমুদিনী মহিলা মেডিকেল কলেজে এমবিবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ঢাকার কোলাহল ছেড়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে, লৌহজং নদীর শান্ত ঢেউয়ের পাশে আমার পড়াশোনার দিনগুলো বেশ কাটছিল। ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস আর বইয়ের পাতায় মগ্ন থাকার দিনগুলো আচমকাই থমকে গেল এক দুঃসংবাদে—বাবার লিভার সিরোসিস ধরা পড়ল।
বাবাকে আমি সবসময় দেখেছি হাসিখুশি, প্রাণবন্ত একজন মানুষ হিসেবে। তার মুখে হাসি ছাড়া অন্য কোনো অভিব্যক্তি দেখিনি। অথচ রিপোর্টের কাগজে লেখা ‘লিভার সিরোসিস’ শব্দগুলো এক নিমিষেই আমাদের ছোট্ট পৃথিবীটা পাল্টে দিল। কুমুদিনীর লেকচার, ল্যাব, বন্ধুদের আড্ডা—সবকিছু যেন ফিকে হয়ে গেল। আমার দিন কাটতে লাগল হাসপাতালের করিডোরে, রিপোর্ট আর ওষুধের কটু গন্ধের ভিড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বাবার মুখে কখনো ভয় দেখিনি। ছিল কেবল এক অদম্য হাসি, যা যেন আমাদের বাঁচার প্রেরণা হয়ে রইল।
মেডিকেশনের হাত ধরে কিছু বছর ভালোই কাটছিল। আমরা ভেবেছিলাম বুঝি ঝড় থেমে গেছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ২০২৩ সালের আগস্টে রুটিন চেকআপে আবারও আঘাত এলো—HCC, অর্থাৎ লিভার ক্যান্সার। আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা! আর ঠিক তখনই সামনে দাঁড়ানো জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা—আমার ফাইনাল প্রফেশনাল এক্সামিনেশন। একদিকে বাবার জীবন-মৃত্যুর লড়াই, অন্যদিকে আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম—যেভাবেই হোক, আমাকে পাশ করতেই হবে। এই লড়াই শুধু আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে পূর্ণ করবে না, এটি হবে বাবার জন্য আমার প্রথম যুদ্ধ।

ভেলরের একটি হাসপাতালে সামনে বাবা ও আমি
ঢাকা টাঙ্গাইল ও হসপিটালে ছোটাছুটির মধ্যেই কোনোভাবে পরীক্ষা শেষ করলাম। কিছুদিন পর রেজাল্ট এলো—আমি পাশ করলাম! নামের আগে কাঙ্ক্ষিত ‘ডা.’ উপাধি যুক্ত হলো বটে, কিন্তু এতদিন ধরে যে সাফল্যের জন্য লড়াই করছিলাম, তার আনন্দটুকু সেদিন যেন অনুভব করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। জীবনের কঠিন বাস্তবতার সামনে আমার এই অর্জন তখন ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
এরপর শুরু হলো ইন্টার্নশিপ। অসম্ভব চাপ, খারাপ অভিজ্ঞতা, আর মানসিক ভাঙন—সবকিছু যেন একসাথে ধেয়ে আসছিল। এর মধ্যেই ডাক্তার জানালেন, “Your father needs a liver transplant as soon as possible.” আমার মাথার ওপর যেন নতুন এক পাহাড় ভেঙে পড়ল। সেই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম—ইন্টার্নশিপ হোল্ড করে ঢাকায় ফিরব। বাবার চিকিৎসার লড়াইকে তখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানালাম। মাকে বাবার পাশে রেখে বাকি সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলাম। টাকা জোগাড় করা, ডোনারের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার প্রতিটি ধাপ সামলানো—একাই সবকিছু করতে হলো।
অবশেষে সবকিছু গুছিয়ে বাবা ও মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম। বেশি কিছু ভাবারও সময় পেলাম না। এই কঠিন সময়ে, যাদেরকে আমি নিজের মানুষ বলে বিশ্বাস করেছিলাম, তাদের অনেকেই দূরে সরে গেল। কিছু মানুষের অপমান, কটু কথা, আর মানসিক চাপ—সবকিছু আমাকে একাই সহ্য করতে হলো। কিন্তু আমার মনোবল ভাঙেনি। আমার ভেতরে একটাই জিদ ছিল, বাবা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি থামব না। আমি জানতাম, আমার বাবাই আমার পৃথিবী।

আইসিইউ’র নীরবতায়—অপারেশনের পর বাবা বিশ্রাম নিচ্ছেন
এই কঠিন সময়ে আল্লাহর অপার করুণা আমাদের পাশে ছিল। আমাদের আশার আলো হয়ে হাজির হলেন ডা. মোহাম্মদ রেলা স্যার, একজন বিশ্ববিখ্যাত লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন। তিনি আমাদের জীবনে সেই আলোর পথ দেখালেন, যা আমরা খুঁজে ফিরছিলাম। তার তত্ত্বাবধানে, বাবার প্রতিটি অস্থির রাত, আমার চোখের জল, হাসপাতালের প্রতিটি করিডোরের নিঃশব্দতা—সবকিছু যেন এক জীবন্ত সিনেমার মতো হয়ে উঠল।

দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পাওয়া এই হাসিটাই আমাদের জয়; কেবিনে বাবা ও আমি।
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২৪। চেন্নাইয়ের রেলা হসপিটালে বাবার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সম্পন্ন হলো। হাসপাতালের সাদা দেয়াল, নার্সদের ফিসফাস, ডাক্তারদের শান্ত চলাফেরা—সবকিছু যেন আমার কাছে ধূসর মনে হচ্ছিল। অপারেশনের দীর্ঘ সময়টুকু আমার কাছে এক অনন্তকাল মনে হয়েছিল। আমি জানতাম না বাবার কী হবে, প্রতি মুহূর্তে এক অজানা আশঙ্কায় ভুগছিলাম। অবশেষে একজন ডাক্তার এসে জানালেন, “অপারেশন সাকসেসফুল। পেশেন্ট এবং ডোনার দুজনেই রিস্ক ফ্রি।” মনে হলো, আমার এই ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ শেষ হলো। সমস্ত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা যেন এক নিমিষে দূর হয়ে গেল।
আজ বাবা সুস্থ। তার চোখে ফিরে এসেছে সেই পুরনো হাসি, মুখে সেই চেনা উজ্জ্বলতা। এই দীর্ঘ যাত্রায় আমি শিখেছি—জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আর সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী হলেন সৃষ্টিকর্তা। প্রতিটি রাত, যখন আমি বাবার পাশে বসে প্রার্থনা করেছি, তার প্রতিটি নিঃশ্বাস আমার জন্য নতুন শক্তি জুগিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ, আমার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হলো—বাবার সুস্থতা নিশ্চিত হলো। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা, তিনি যেন আর কখনো আমাদের এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি না করেন। আর যদি করেনও, তবে যেন সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো অদম্য সাহস আর শক্তি আমাকে দান করেন।