
লেখক ও নির্মাতা
কুয়াকাটার ভাঙন এক ভয়াবহ ঝুঁকির নাম। বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের এই অনন্য সৈকত, যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকরা এই রুপালী বালুর রেখার কাছে ভিড় জমায়। কেউ শান্তির খোঁজে, কেউ প্রকৃতির অপরূপ রূপের সাক্ষী হতে। কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের চিরন্তন গর্জনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। ভাঙন, জলোচ্ছ্বাস এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান উচ্চতা কুয়াকাটার উপকূলে ঘনিয়ে আনছে এক অনিশ্চিত ভবিশ্যত। বালুর সঙ্গে উবে যাচ্ছে হাজার হাজার গাছের শিকড়। একসময়ের নারিকেল ও ঝাউবন এখন কেবল স্মৃতিতে। ক্ষুদ্র পরিবারগুলো হারাচ্ছে তাদের বাস। প্রতিটি ঢেউ শুধু বালু সরাচ্ছে না; জীবনের গল্পও মুছে দিচ্ছে। মুছে দিচ্ছে মানুষের, বনজের, এবং সমুদ্রের এক সঙ্গে চলার গল্প। একসময়ের প্রাণবন্ত কুয়াকাটা আজ ক্রমেই ভঙ্গুর, জৌলুশহীন এবং অজানা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সারি সারি জিও ব্যাগ ফেলে কুয়াকাটা মেইন বিচের ক্ষয় রোধের চেষ্টা। সৈকতের দৃশ্য ক্রমশ ভঙ্গুর ও অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন। তুলেছেন: মোঃ মাহমুদুল হাসান
১৯৬০ সালে ফয়েজ মিয়া ১৬৭ একর খাস জমি লিজ নিয়ে নারিকেল বাগান গড়ে তোলেন, যা কেবল ছায়া দেয়নি, বরং উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের আক্রমণে নারিকেল গাছ, বাগানের কাঠামো, এমনকি স্থানীয় জীবনের ছোঁয়াও সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে।
গত এক দশকে কুয়াকাটার অসাধারণ উপকূলীয় সৌন্দর্যের অন্তত আটটি মূল স্পট—ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান, ঝাউবন, লেম্বুরবন, আদর্শ জেলে পল্লি, কুয়াকাটা ইকোপার্ক, গঙ্গামতি চর, শুঁটকি পল্লি এবং সৈকতসংলগ্ন নারিকেলবাগান—আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কুয়াকাটার ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান একসময় পর্যটক ও স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল। বঙ্গোপসাগরের তীব্র ভাঙন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এটি বর্তমানে সমুদ্রের তলে বিলীন। ছবি: সাগরকন্যা কুয়াকাটা ফেইসবুক পেইজ থেকে।
২০০৫ সালে কুয়াকাটার ঝাউবনকে সরকারি উদ্যোগে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্থানীয়দের তথ্য অনুসারে, উদ্যানের মোট আয়তন ছিলো প্রায় ১,৬১৩ হেক্টর। উদ্দেশ্য ছিল বনজ জীব, উদ্ভিদ এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ করা, পাশাপাশি পর্যটন সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা। কুয়াকাটার স্থানীয় বাসিন্দা ও দৈনিক জনকন্ঠের স্থানীয় প্রতিনিধি আবুল হোসেন রাজু জানান-
ঝাউবনের বেশিরভাগ বনই ইতিমধ্যেই সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়েছে এবং প্রতি বছর বনাঞ্চল আরও ক্ষয় হচ্ছে। এই হারানো বন কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং স্থানীয় ইকোসিস্টেম এবং পর্যটনের প্রধান আকর্ষণকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
কুয়াকাটার স্থানীয়রা আরো জানান, প্রতি বছর গড়ে ২০–৩০ মিটার করে সৈকত সরে যাচ্ছে ভেতরের দিকে। কৃষকের জমি লবণাক্ত পানিতে অনুর্বর হচ্ছে, জেলেদের জালে ধরা পড়ছে কম মাছ। এসব কারনে যারা একসময় ধান ফলাতেন বা সমুদ্রে মাছ ধরতেন, তাদের অনেকেই আজ শহরমুখী। প্রতিটি ভাঙা গাছ, বিলীন হওয়া ঝাউবনের ছায়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কতটা ক্ষণজীবী প্রকৃতির সৌন্দর্য, যদি তা সংরক্ষণের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না যায়।
এই ভাঙনের সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও শিশুরা। শুধু ঘরবাড়ি নয়, সমুদ্র গ্রাস করছে তাদের ভবিষ্যৎও। লবণাক্ত জলে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব—এসব মিলিয়ে প্রতিদিন বেড়ে চলেছে অনিশ্চয়তা। শিশুরা হারাচ্ছে শিক্ষা ও খেলার অধিকার; স্কুলের বেঞ্চ ছেড়ে তারা নামছে জীবিকার সংগ্রামে। কেউ জাল হাতে, কেউবা শ্রমের ভার কাঁধে—সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা লড়ছে টিকে থাকার লড়াইয়ে।

সমুদ্রপাড়ে দাঁড়ানো শিশুরা—উপকূলের ভাঙনের সঙ্গে লড়াই করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি। তুলেছেন: দানিয়েল ড্যানি
কুয়াকাটা—একটি সুন্দর, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ উপকূল। এখানে ঢেউ যেমন বালুচর ছুঁয়ে যায়, তেমনি মানুষও প্রতিদিন প্রকৃতির সঙ্গে এক অন্তহীন টানাপোড়েনে বাঁচে। হোটেল আর পর্যটননির্ভর ব্যবসা অর্থনীতিতে প্রাণ দেয়, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ, বর্জ্য আর বন ধ্বংস প্রকৃতির নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে রোধ করছে।
কুয়াকাটাকে রক্ষা করতে কেবল কংক্রিট বাঁধ বা সরকারি প্রকল্প যথেষ্ট নয়। দরকার প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পুনর্গঠন—যেখানে প্রত্যেকে নিজেদের ভূমিকা বুঝবে। টেকসই ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন তিনটি সম্মিলিত মিশন:
১. স্থানীয় কমিউনিটি: যারা প্রতিদিন এই উপকূলের সঙ্গে বাঁচে—তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও উদ্যোগকে কেন্দ্র করে পরিবেশবান্ধব জীবিকা গড়ে তোলা।
২. সরকার ও প্রশাসন: সঠিক নীতিমালা, দীর্ঘমেয়াদি উপকূল ব্যবস্থাপনা, আর বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
৩. সচেতন ভ্রমণকারী: যারা শুধু সৌন্দর্য দেখতে আসে না, বরং স্থানীয় সংস্কৃতি ও প্রকৃতির প্রতি সম্মান রেখে ভ্রমণ করে—‘রেসপনসিবল ট্যুরিজম’-এর অংশীদার হয়।
এই তিন শক্তি একসাথে কাজ করলে কুয়াকাটার সত্যিকারের ধন—মানুষ, বন ও সমুদ্র—আবারও জীবন্ত হয়ে উঠবে।
🌱 হোম-স্টে প্রোগ্রাম:
কুয়াকাটার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নতুন জীবনরেখা দিতে পর্যটকদের জন্য চালু হতে পারে হোম-স্টে সার্ভিস। ভ্রমণকারীরা স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে থেকে তাদের খাবার, সংস্কৃতি ও সংগ্রাম কাছ থেকে দেখবেন; আর পরিবারগুলো পাবে টেকসই বিকল্প আয়ের সুযোগ।
🌊 কমিউনিটি গাইড উদ্যোগ:
জেলে ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হবে কমিউনিটি ট্যুর গাইড বা হস্তশিল্প উদ্যোক্তা। তারা শুধু ভ্রমণ দেখাবেন না, বরং নিজেদের গল্প শোনাবেন—যেখানে থাকবে সমুদ্র, সংগ্রাম ও আশার বর্ণনা।
☀️ পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট:
সোলার এনার্জি, পানি সাশ্রয় ও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবহার করে তৈরি হবে ছোট আকারের পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট। পর্যটন বাড়বে, কিন্তু প্রকৃতির ক্ষতি নয়—বরং সংরক্ষণই হবে মূল দর্শন।
🌍 ট্যুরিস্ট ফান্ড (গ্রীন ফান্ডিং মডেল):
প্রতিটি ভ্রমণ থেকে একটি সামান্য ফি সরাসরি ব্যয় হবে পুনর্বাসন, বৃক্ষরোপণ ও শিশু শিক্ষায়। এর মাধ্যমে পর্যটন হবে কেবল আনন্দের নয়, পরিবর্তনের অংশও।

পর্যটকরা স্থানীয় পরিবারের সঙ্গে থেকে তাদের জীবন, খাবার ও সংস্কৃতি অভিজ্ঞতা করবেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পাবে বিকল্প আয়ের সুযোগ। প্রতিকী ছবি।
কুয়াকাটার টেকসই ভবিষ্যতের জন্য দরকার সরকারের পরিকল্পনা আর স্থানীয় মানুষের জ্ঞান–অভিজ্ঞতার সমন্বয়। সর্বশেষ তথ্য (২০২৪ সালের শেষ নাগাদ) অনুযায়ী, জিরো পয়েন্টে যেখানে সৈকতের প্রস্থ মাত্র কয়েকশ মিটারে নেমে এসেছে এবং যেখানে বছরের পর বছর ধরে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব দিয়ে অস্থায়ীভাবে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে এখন প্রকৃতির শক্তির ওপর ভিত্তি করে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান চাই।
শুধুমাত্র কংক্রিট বেড়িবাঁধ নয়, পরিবেশবান্ধব কৌশলই স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রোইন বাঁধের জরুরি বাস্তবায়ন, যার জন্য স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি, ভেটিভার ঘাসের জাল, দ্রুত বর্ধনশীল তালগাছের বেষ্টনী বা ম্যানগ্রোভের প্রাকৃতিক বেষ্টনী—যা শুধু ভাঙন রোধ করবে না, বরং জীববৈচিত্র্যও ফিরিয়ে আনবে এবং বিলীন হওয়া ঝাউবন ও নারকেল বাগানের ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণ করবে।

কুয়াকাটার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত কংক্রিট রাস্তা; জিও ব্যাগ ও জিও টিউব দিয়ে সাময়িক রক্ষা চেষ্টা করা হয়েছে। তুলেছেন: মোঃ মাহমুদুল হাসান
পর্যটন খাতে চাই কঠোর স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ—ব্যাটারিচালিত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, মানসম্মত রেস্টুরেন্ট ও সেবার মানোন্নয়ন। এতে যেমন ভ্রমণকারীর অভিজ্ঞতা বাড়বে, তেমনি স্থানীয় অর্থনীতিও শক্ত ভিত্তি পাবে। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা (টোয়াক) যেমনটি বারবার বলছে, অপরিচ্ছন্নতা যেন জিরো পয়েন্টের সৌন্দর্য নষ্ট না করে।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্র যদি তাদের জমি ও জীবিকা কেড়ে নেয়, তবে নতুন উদ্যোগ—ইকো–ট্যুরিজম, হস্তশিল্প, বা সবুজ উদ্যোক্তা কার্যক্রম—হতে পারে তাদের জীবনের নতুন দিগন্ত।
কুয়াকাটা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়—এটি পৃথিবীর জলবায়ু সংকটের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ এখানে দরিদ্র মানুষের জীবন, জমি এবং ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই বৈশ্বিক সহায়তা কেবল দান নয়; এটি এখানে বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের অংশ।
🌍 আন্তর্জাতিক সহায়তা: জলবায়ু অভিযোজন, ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের শিক্ষা ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে UNDP, UNICEF ও বিশ্বব্যাংকের দ্রুত ও কার্যকর হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। বিশেষত, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, এই ভাঙন থামাতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা জরুরি।
💼 কর্পোরেট গ্রীন ফান্ডিং: টেলিকম, FMCG (Fast-Moving Consumer Goods) এবং ব্যাংকিং খাতের CSR (Corporate Social Responsibility) তহবিলকে সরাসরি কুয়াকাটার টেকসই বাঁধ, সুপেয় পানি প্রকল্প ও স্থানীয় পুনর্বাসন উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে হবে।

কুয়াকাটার সংকটকে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখলে চলবে না; এটি আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকারের প্রতিচ্ছবি। বিলীন হওয়া ঝাউবন আর ফয়েজ মিয়ার বাগানের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়: জিও ব্যাগ বা টিউবের অস্থায়ী সমাধান যথেষ্ট নয়। এখন দরকার টেকসই বেড়িবাঁধ এবং সবুজ বেষ্টনীতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। প্রকৃতির সুরক্ষায় এই উদ্যোগ কোনো ব্যয় নয়, এটি আমাদের অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের জন্য অপরিহার্য বিনিয়োগ।
এই বিনিয়োগ কেবল সরকারি কোষাগার থেকে নয়; সুরক্ষার অংশীদার হতে হবে ভ্রমণকারীকেও। সমুদ্রের তীরে তার প্রতিটি পদক্ষেপ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এমনকি কেনাকাটার সিদ্ধান্তও এই উপকূলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। একজন সচেতন ভ্রমণকারী হিসেবে আপনার আমার দায়িত্ব হলো—“কোনো চিহ্ন না রেখে যাওয়া” (Leave No Trace) নীতি মেনে চলা, এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সমর্থন করা। প্রতিটি সঠিক সিদ্ধান্ত, প্রতিটি সচেতন আচরণ যেন স্থানীয় জীবিকা ও পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করে—সেই প্রতিশ্রুতিই কুয়াকাটার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।
যদি সরকার তার প্রতিশ্রুতি রাখে, স্থানীয়রা সম্মিলিতভাবে অংশ নেয়, আর ভ্রমণকারী নিজের দায়িত্ব বোঝে—তবেই সাগরকন্যা আবারও দাঁড়াবে টেকসই উন্নয়নের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে।