| মুভি | লায়ন অব দ্য ডেজার্ট |
|---|---|
| অর্থায়ন | লিবিয়ার সরকার (মুয়াম্মার গাদ্দাফি) |
| পরিচালক ও প্রযোজক | মুস্তাফা আল আক্কাদ |
| রাইটার | এ.এল. ক্রেইগ |
| ডিওপি | জ্যাক হিল্ডইয়ার্ড |
| মিউজিক | মরিস জারে |
| এডিট | জন শার্লে |
| সময়কাল | ১৭৩ মিনিট |
| রিলিজ | ১৭ এপ্রিল ১৯৮১ |
| কাস্ট | এন্থনি কুইন, অলিভার রিড, আইরিন পাপাস, রাফ ভেলোন, রড স্টেইগার |
| বাজেট | ৩৫ মিলিয়ন ডলার |
| জনরা | বায়োপিক |

মহিমান্বিত মৃত্যু লাভ বড় সহজ কথা নয়।
আনন্দ-বেদনা, ঘাত-প্রতিঘাত সাফল্য ব্যর্থতার ষাট-সত্তুর বছরের যে জীবন আমরা পাই তা যাপন শেষে বিদায়ের মুহূর্তে পৃথিবী আমাদের জন্য কাঁদবে, এমন মহিমান্বিত বিদায় পৃথিবীর ইতিহাসে হাতে গোনা মাত্র কয়েক’জন মানুষের ভাগ্যে জুটেছে। লিবিয়ার বেদুইন বিপ্লবি ওমর আল মুখতার তেমনই একজন মানুষ। মুসোলিনির ডান হাত জেনারেল গ্র্যাজিয়ানির (Rodolfo Graziani) প্রহসনের আদালতে যখন ওমর আল মুখতারকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয় প্রতিপক্ষও তখন তাঁকে সেল্যুট দিয়েছিলো, আর অঝোরে কেঁদেছিলো দুনিয়ার অযুত-নিযুত মজলুম।
লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারের অর্থায়নে মরক্কো বংশোদ্ভুত হলিউডের পরিচালক মুস্তাফা আক্কাদ (Moustapha Al Akkad) নির্মিত লায়ন অব দ্য ডেজার্ট মুভিটি ওমর আল মুখতারের বায়োপিক। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া এই মুভির বাজেট ছিলো ৩৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। বলা বাহুল্য, ইতালিতে মুভিটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমি যত বায়োপিক দেখেছি, প্রায় সবগুলোতেই ইতিহাসের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় বস্তু আছে, এক কথায় গোজামিল। তাদের বানানো বায়োপিক দেখে সত্য জানার বদলে বিভ্রান্তই হতে হয়- এরা বায়োপিক বানায় মূলত পছন্দসই প্রপাগান্ডাকে ইতিহাসের অংশ করার মনোভাবে। কিন্তু মুস্তফা আক্কাদ ওমর আল মুখতারের জীবনি চিত্রায়নে বাড়ানো-কমানোর কাজটি করেন নি, সত্য যেটুকু আছে তিনি ততটুকুই চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন। কথাটি আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারছি কারন লায়ন অব দ্য ডেজার্ট মুভিটি দেখার অনেক আগেই ওমর আল মুখতারের দুঃসাহসিক কর্মকান্ডের ইতিহাস আমি পড়েছি বিস্তারিত। একটি ইন্টরেস্টিং বিষয় যেটি ইতিহাসে আছে, কিন্ত ফিল্মে আমি পাইনি সেই বিষয়টি ধরেই গল্প আলোচনায় প্রবেশ করা যাক-

দীর্ঘ ২০ বছর সাধনার পর রাজাকারদের সহায়তায় ওমর আল মুখতারকে ধরতে সক্ষম হয় ইতালিয়ান রয়্যাল আর্মি। তাও নিন্তান্তই দুর্ভাগ্যবসত। প্রচন্ড গোলাবর্ষণের মুখে ওমর আল মুখতারের ঘোরাটা দ্রুত ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, ঘোরার পিঠ থেকে ছিটকে পরে কোমরে আঘাত পান মুখতার। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ইতালিয়ান রয়্যাল আর্মির সাথে যুদ্ধ করা ৭৩ বছর বয়স্ক আরব বেদুইন ওমর আল মুখতার এই আঘাত সামলে আর উঠে দাঁড়াতে পারেন নি, এবং এর কিছুপরই হাজার হাজার ইতালিয়ান সোলজার তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। অতঃপর ফ্যাসিস্ট সরকারের নুন খাওয়া আত্মনিবেদিত জেনারেল গ্র্যাজিয়ানির সামনে নিয়ে গেলে জেনারেল ওমর আল মুখতারকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়, কেননা জেনারেল ভেবেছিলো ওমর আল মুখতার হবে শক্তসমর্থ প্রচন্ডদর্শন এক পুরুষ, কিন্তু আদতে দেখা যাচ্ছে ওমর আল মুখতার ৭৩ বছর বয়স্ক মাঝারি উচ্চতার ভগ্ন স্বাস্থের এক বৃদ্ধ, যাকে দেখলে ভেতরের আগুন সম্পর্কে কোন আভাস পাওয়া যায় না। গ্র্যাজিয়ানির বিশ্বাস হতে চায় না, এই কী সেই দূর্ধর্ষ মুখতার যার জন্য ইতালির মত পরাশক্তি ২০ বছর ধরে লিবিয়ার মাটিতে খাবি খাচ্ছে! এই কী সেই দূর্ধর্ষ আরব বেদুইন নেতা যে প্রায়শ দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে সয়ং মুসোলিনির নিদ্রায়- এই ঘটনাটি মুভিতে নেই।
পেশায় শিক্ষক, ইসলামিক স্কলার, স্বল্পভাষী, বিনয়ী অথচ অবিচারের প্রতিকুলে প্রচন্ড একরোখা নাছোড় বিপ্লবি দুর্ধর্ষ বেদুইন ওমর আল মুখতার ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দে লিবিয়ার সিরেনিকার জানযুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুসোলিনির ইতালির লিবিয়ায় সামরিক অভিযানের শুরুতেই শান্ত ধর্মভীরু মুখতার সিন্ধান্ত নেন তাঁর ভূখন্ডের মজলুম মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। একদমই সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত মুখতারের এত বড় সিদ্ধান্তের পেছনে একমাত্র রসদ ছিলো স্রষ্টার প্রতি নিরঙ্কুশ ভরসা এবং পবিত্র কোরআনের বাণী-পবিত্র কোরআনে জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। মুখতার অতঃপর ছোট একটি বেদুইন দল নিয়ে দাঁড়িয়ে যান গ্র্যাজিয়ানির গণবিধ্বংসী আর্টিলারির বিপরিতে- যুদ্ধ চলে ২০, মতান্তরে ২৩ বছর। মুখতার ছিলেন প্রচন্ড সাহসি এবং চতুর। মরু অঞ্চলে তাঁর রণকৌশল নিয়ে আজ অবদি গবেষণা চলছে। ইতালিয়ান রয়্যাল আর্মি হাজার হাজার সৈন্য, অস্ত্র, আর্টিলারি, যুদ্ধ বিমান নিয়েও এক মুখতার বাহিনীর কাছেই নাস্তানাবুদ হচ্ছিলো যখন-তখন। মুখতার মূলত তাঁর ছোট বাহিনী নিয়ে গেরিলা হামলা চালাতেন। তিনি ছোট দলটি নিয়ে ঘোরায় টগবগিয়ে এসে চোখের পলকে ঘটনা ঘটিয়ে চলে যেতেন- দখলদার ইতালিয়ানরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখতো ধ্বংসাবশেষ পরে আছে, যা গ্র্যাজিয়ানিকে একই সাথে লজ্জিত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করত। উপায় অন্তর না দেখে গ্র্যাজিয়ানি ওমরের সাথে সন্ধি করার জন্য আর্মি থেকে প্রতিনিধি পাঠালো। তারা মুখতারের কাছে নানা প্রলোভনের বিনিময়ে দাবি করল লিবিয়ায় নিরঙ্কুশ শাসন-অধিকার। কিন্তু মুখতার বললেন,
‘আমরা জানি তোমাদের সামরিক শক্তি, প্রয়োজনে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যুদ্ধ করবো কিন্তু তোমাদের অন্যায় শাষনের কাছে নতি স্বীকার করবো না। আমাদের ভূখন্ডে এক সেকেন্ড থাকারও কোন অধিকার নেই তোমাদের।’
এরপর বলা বাহুল্য, সন্ধির সম্ভাবনা ভেস্তে গেল। মুখতার রণকৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন এনে মিশরের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখলেন। দিশেহারা ইতালিয়ান আর্মি, আর্মির যেমন চরিত্র, সোজা পথে না পেরে বাঁকা পথ অবলম্বন করলো। প্রচুর পুরস্কারের বিনিময়ে মুখতারকে জীবিত ধরার লক্ষে নিয়োগ করলো মুখতারেরই স্বদেশীদের- রাজাকার। এর কিছু দিন পরই মুখতারকে আটক করতে সক্ষম হল গ্র্যাজিয়ানির আর্মি।

মুখতারের ফাঁসির পর গ্র্যাজিয়ানি মুখতার সম্পর্কে বলেছিলো,
‘ওমর আল মুখতার ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি সম্পন্ন, ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী, শক্তিসম্পন্ন ও ক্ষীপ্র ব্যক্তি, নিঃস্বার্থ ও আপোষহীন। যিনি বহু কষ্টে নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছেন।’
মুখতারকে সামনে পেয়ে গ্র্যাজিয়ানি কিছুটা সম্মান প্রদর্শন করলো এবং তাকে প্রস্তাব দিলো, যদি সে অবসরে যায় এবং ইতালি সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে তবে তাকে প্রতি মাসে ৫০০০০ দিনার ভাতা সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে। জবাবে মুখতার মৃদু হেসে না সূচক মাথা নাড়েন। গ্র্যাজিয়ানি অবাক হয়ে বলে, Why?
মুখতার গ্র্যাজিয়ানির চোখে চোখ রেখে বলেন,
What you would do if somebody occupy your land? You would do the same what I did…
গ্র্যাজিয়ানি এরপর আর কালক্ষেপণ না করে এক জুনিয়র অফিসারকে ডেকে বলে, ‘ওকে বিচারের মুখোমুখি কর। এবং বিচারককে বলে দাও, ওর শাস্তি হবে ওরই মানুষের সামনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু।’
ওমর আল মুখতারের ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর অনন্য এক ঘটনা ঘটে, যা গোটা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। একজন সুন্নি মুসলিম হিসেবে মুখতার আমৃত্যু ইসলামের নবীকে অনুসরণ করেছেন। নবীর আদর্শ অনুযায়ি ওমর যুদ্ধবন্দিদের উপর কখনও অত্যাচার করতেন না, তিনি বিভিন্ন সময়ে ইতালীয় সৈন্যদের বন্দি করে কোন প্রকার টর্চার না করে ছেড়ে দিয়েছেন। ওমরের উদারতায় নিশ্চিৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছে অনেক সৈন্য। ফলে মুখতারের নিশ্চিৎ ফাঁসির খবরে ইতালিয়ান আর্মির ভেতরেই একটি অংশ প্রচন্ড কষ্ট পায়, গোপনে কাঁদে। যদিও সে কান্না মুখতারের ফাঁসি রুখতে পারে নি। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালের ঠিক ফাঁসির আগমুহূর্তে মুখতার পবিত্র কোরআন থেকে পাঠ করলেন,
‘হে প্রশান্ত মন, তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট এবং সন্তোষভাজন হয়ে, অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, উপরোক্ত আয়াতসমূহ পবিত্র কোরআনের সূরা ফজরের অংশ, আয়াত ২৭-৩০।

হলিউড অভিনেতা এন্থনি কুইন হলেন পর্দার মুখতার, তিনি এতটাই আত্মস্থ হয়ে চরিত্রটি ফুঁটিয়ে তুলেছেন যে ওমর আল মুখতারের কথা মনে পড়লে আমার সামনে এখন এন্থনি কুইনের চেহারাটা ভেসে ওঠে। তবে ইতালিয়ান সেনানায়ক রোডলফো গ্র্যাজিয়ানি চরিত্রে অলিভার রিড এক কথায় দুর্দান্ত। মুভিতে সব থেকে ইন্টরেস্টিং চরিত্র মুসোলিনি, রডনি স্টেইগার যে মুসোলিনিকে দেখালেন, মুসোলিনির ব্যক্তিত্ব যদি এটাই তবে মালটা বেশ পিক্যুলিয়ার ছিলো বলতেই হয়। ডিরেক্টর মুস্তাফা আল আক্কাদের সব থেকে বড় সফলতা আমি মনে করি ছোট বড় প্রতিটি চরিত্র তিনি শতভাগ বিশ্বাসযোগ্যতায় পর্দায় এনেছেন। ফিল্ম মেইকিং এর সাথে যুক্ত আছি বলে আমি জানি, কাজটি শুধু কঠিন নয়, ভয়াবহ কঠিন, বিশেষ করে ইতিহাসের এমন গুরুত্ববহ চরিত্রের বায়োপিক নির্মাণে। মুভিতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং খুব একটা ব্যবহৃত হয় নি, যতটুকু হয়েছে ততটুকু করেছেন মরিস জারে। ডিরেক্টর অফ ফটোগ্রাফি জ্যাক হিলইয়ার্ড।

এই হলো আমার অতি পছন্দের একটি মুভি নিয়ে আমার আলোচনা। এবার একটু বলি, মুভিটি বা ওমর আল মুখতার কেন আমার এত পছন্দ? বর্তমান সময়টা চলছে কাপুরুষতার স্বর্ণযুগ। এই সময়ে, ভালো থাকার জন্য, নির্ভেজাল শান্তিময় জীবন যাপনের জন্য আমরা প্রধানতম অবলম্বন করেছি কাপুরুষতাকে। আমরা প্রচুর স্মার্ট, সুতরাং আমরা আবিচার দেখবো, আবিচার বুঝবো কিন্তু অবিচার আমার আঙিনায় এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত কোন আওয়াজ দেবো না। ফলে কাপুরুষের এক সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীতে আমরা যত মানুষ এই মুহূর্তে বেঁচে আছি, সবই মনে হয় কাপুরুষ। এই কাপুরুষের সমুদ্রে ডুবে ডুবে যখন হাঁপিয়ে উঠেছি ঠিক তখনই মরুসিংহ ওমর আল মুখতারের জীবনি পড়ার সুযোগ হয় ভাগ্যক্রমে। এরপর বেশ কিছু দিন আমি মুখতারে ডুবে ছিলাম। বলা বাহুল্য, খুব শান্তি পেয়েছি সেই কটা দিন। আমার মত হাসফাঁস অবস্থায় যদি কেউ পরেন তাহলে এক বসায় দেখে ফেলতে পারেন মুভিটি। মুভির নাম, লায়ন অব দ্য ডেজার্ট- ওমর আল মুখতার।
