
মানসিক প্রশান্তি। প্রতিকী ছবি— সংগৃহীত।
সুখ! এই শব্দটি আমাদের অস্তিত্বের গভীরে এমন এক অনুসন্ধান জাগিয়ে তোলে, যার পেছনে ছুটে চলেছি আমরা সবাই। প্রতিটি সকাল শুরু হয় সুখের এক নতুন সংজ্ঞাকে ছোঁয়ার আশায়। ভালো চাকরি, সাজানো সংসার, সামাজিক প্রতিষ্ঠা—এগুলো কি সুখের চাবিকাঠি? নাকি সুখের ঠিকানা আরও নিগূঢ়, আরও গভীরে লুকানো?
আমাদের প্রথাগত ধারণা হলো, সুখ মানেই আনন্দ, স্বস্তি আর অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু মনোবিজ্ঞানের জটিল গবেষণায় এই সরল সংজ্ঞাটি প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড. পল রোজিন এবং তার সহকর্মীরা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মানুষ প্রায়শই “হেডোনিক ট্রেডমিল”-এর ফাঁদে পড়ে। এর অর্থ হলো,
আমরা যখন একটি নির্দিষ্ট সুখের লক্ষ্যে পৌঁছাই, তখন দ্রুতই তার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়ি এবং নতুন করে আরও বেশি সুখের খোঁজে ছুটি। এই অন্তহীন দৌড় আমাদের জীবনের গভীরতর অর্থ থেকে বিচ্যুত করতে পারে।

‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর একটি সাম্প্রতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখায় এই বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। তারা বলছে, জীবনের সত্যিকারের পূর্ণতা আসে কেবল নিরবচ্ছিন্ন সুখে নয়, বরং “সাইকোলজিক্যাল রিচনেস” বা মানসিক সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। এই ধারণাটি আমাদের প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে।
ভাবুন তো, একটি জীবন যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত আরামদায়ক, প্রতিটি ঘটনা আনন্দময়। কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, কোনো হতাশা নেই, কোনো নতুনত্বের ছোঁয়া নেই। প্রথমত, এমন জীবন স্বপ্নের মতো মনে হলেও, মনোবিজ্ঞানী ড. ক্যানটার এবং ড. মেসোর গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদে এই ধরনের ‘প্লেজার-সেন্ট্রিক’ জীবন একঘেয়েমি এবং অর্থহীনতার জন্ম দিতে পারে। মানুষ তখন আফসোস করে,
"আরও কিছু তো করা যেত, জীবনটাকে আরও অন্যভাবে দেখা যেত।"
অন্যদিকে, যারা জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান—সফলতা-ব্যর্থতা, আনন্দ-বেদনা, ভুল-ত্রুটি, ভ্রমণ, নতুন সম্পর্ক তৈরির মতো জটিল অধ্যায়গুলোও যারা সাহসের সাথে গ্রহণ করেন—তাদের জীবন হয় অনেক বেশি সমৃদ্ধ।

প্রতিকী ছবি— সংগৃহীত
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড. লরা কার্স্টেনস তার ‘সোসোএমোশনাল সিলেটিভিটি থিওরি’-তে দেখিয়েছেন যে, জীবনের শেষভাগে মানুষ যখন তার সময়কে সীমিত মনে করে, তখন তারা অর্থপূর্ণ এবং গভীর অভিজ্ঞতাগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দেয়, নিছক আনন্দের পেছনে ছোটে না।
মনোবিজ্ঞানের হেডোনিক ট্রেডমিল বা সুখের চলন্ত পথ ধারণা অনুযায়ী, মানুষ প্রাথমিকভাবে নতুন আনন্দ বা সাফল্যে উত্তেজিত হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। নতুন মোবাইল, নতুন বাড়ি, বা প্রত্যাশিত ভ্রমণের আনন্দ প্রথমে উচ্ছ্বাস জাগায়, কিন্তু কিছু মাস পরে আমরা সেই অভিজ্ঞতার জন্য অভ্যস্ত হয়ে যাই এবং পুনরায় নতুন কিছু চাইতে শুরু করি।
এই প্রক্রিয়াটিকে হেডোনিক ট্রেডমিল বলা হয়। অর্থাৎ, কেবল আনন্দের পেছনে ছুটলে আমরা দীর্ঘমেয়াদী সুখ বা সমৃদ্ধি পাই না। বরং জীবনের প্রকৃত সমৃদ্ধি আসে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা ও মানসিক প্রশান্তি থেকে—যেখানে আমরা জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, নতুন সম্পর্ক, ভ্রমণ, এবং দৈনন্দিন ছোট ছোট মুহূর্তের মধ্য দিয়ে শিখি, বৃদ্ধি পাই এবং মানসিক সমৃদ্ধি অর্জন করি।

জীবনের প্রকৃত সমৃদ্ধি আসে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা ও মানসিক প্রশান্তি থেকে। প্রতিকী ছবি— সংগৃহীত
আসলে, সুখ হয়তো শুধু হাসিতে বা প্রাপ্তিতে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করার সক্ষমতায়। একজন শিক্ষক যিনি তার ছাত্রদের শত ব্যর্থতা দেখেছেন, আবার তাদের সাফল্যের মুহূর্তে গর্বে বুক ফুলিয়েছেন—তার জীবনের সমৃদ্ধি এক অন্যরকম। একজন তরুণী যিনি অপ্রত্যাশিতভাবে চাকরি হারিয়েছেন, হতাশার গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু সেখান থেকেই নতুন কোনো উদ্যোগ শুরু করার সাহস খুঁজে পেয়েছেন—তার সেই কষ্টকর যাত্রাই তাকে গভীরভাবে বদলে দিয়েছে। এই ধরনের উত্থান-পতন মানুষকে আরও শক্তিশালী এবং প্রজ্ঞাবান করে তোলে, যা নিছক আনন্দ কখনো দিতে পারে না।

সুখ হয়তো শুধু হাসিতে বা প্রাপ্তিতে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করার সক্ষমতায়। প্রতিকী ছবি— সংগৃহীত
সুখ যদি কেবল ক্ষণিকের আনন্দ হয়, তবে তা দ্রুতই ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু সুখ যদি হয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা, তাহলে তা স্থায়ী ছাপ ফেলে জীবনে।
মনোবিজ্ঞানী ড. মার্টিন সেলিগম্যান, যিনি ‘পজিটিভ সাইকোলজি’-র জনক হিসেবে পরিচিত, তার ‘PERMA’ মডেলে দেখিয়েছেন যে, সত্যিকারের সুখের জন্য কেবল ‘প্লেজার’ বা আনন্দই যথেষ্ট নয়, এর সাথে দরকার ‘এনগেজমেন্ট’ (কাজে নিমগ্নতা), ‘রিলেশনশিপ’ (ইতিবাচক সম্পর্ক), ‘মিনিং’ (অর্থপূর্ণ জীবন) এবং ‘অ্যাচিভমেন্ট’ (অর্জন)। এই উপাদানগুলো সম্মিলিতভাবে আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে।

অজানা পথে পা বাড়ানো, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ—এগুলো সবই আমাদের মানসিক সমৃদ্ধি বাড়ায়। প্রতিকী ছবি— সংগৃহীত
কেবল আরামের খোঁজে না ছুটে, জীবনের নতুন চ্যালেঞ্জগুলোকে স্বাগত জানাতে হবে। অজানা পথে পা বাড়ানো, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, নতুন কিছু শেখার আগ্রহ—এগুলো সবই আমাদের মানসিক সমৃদ্ধি বাড়ায়। ব্যর্থতাকে জীবনের শেষ বলে মনে না করে, তাকে একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে নিতে হবে।
সুখ খোঁজা ভুল নয়। কিন্তু কেবল ক্ষণিকের সুখের পেছনে দৌড়ালে জীবনের গভীরতা হারায়। বরং সুখকে খুঁজে নিতে হবে জীবনের অভিজ্ঞতার গভীরে—হাসি-কান্না, জয়-পরাজয়, সাফল্য-ব্যর্থতা, আলো-আঁধারের মধ্য দিয়ে। যখন আমরা এই সবকিছুকে আলিঙ্গন করতে শিখব, তখনই হয়তো একদিন তৃপ্তির সাথে বলতে পারব, “হ্যাঁ, আমার জীবন পূর্ণ ছিল।”