অস্কারের ইতিহাস ও গুরুত্ব: ছোট অনুষ্ঠান থেকে বিশ্বজুড়ে দ্যুতি

১৯২৯ সালের ১৬ মে, মাত্র ২৭০ অতিথির সামনে ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে রুজভেল্ট হোটেলে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় অস্কার পুরস্কারের বিতরণ। তখনকার সময় এটি ছিল একেবারে ছোট ও সাদামাটা অনুষ্ঠান, যা মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় মোট ১২টি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। আর আজ? অস্কার অনুষ্ঠান বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশন এবং অনলাইনে সরাসরি অনুষ্ঠান দেখতে বসে, যেখানে বিশ্বের নামকরা অভিনেতা-পরিচালকরা লাল গালিচায় হাঁটেন।

অস্কারের নামকরণ ও মূর্তির রহস্য

“Academy Award of Merit” নামেই অফিসিয়ালি পরিচিত এই পুরস্কার। কিন্তু ‘অস্কার’ নামে ডাকা হয় এক মজার কারণে—একাডেমির গ্রন্থাগারিক মার্গারেট হেরিক একদিন বলেছিলেন, পুরস্কারটির আকৃতি তার মামা ‘অস্কার’র মতো দেখতে। সেই নাম ছড়িয়ে পড়ে আর স্থায়ী হয়। পুরস্কারটির মূর্তি ডিজাইন করেন শিল্পী সেড্রিক গিবন্স। এটি একজন নাইটের মূর্তি, হাতে তলোয়ার এবং পায়ের নিচে ফিল্ম রিল, যা শিল্প ও সাহসের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

অস্কারের নামকরণ ও মূর্তির রহস্য

অস্কারের গুরুত্ব: শুধু সম্মান নয়, ক্যারিয়ারের গতি

অস্কার জেতা মানে শুধু সোনালি মূর্তি হাতে পাওয়া নয়, বরং একজন শিল্পীর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ক্যারিয়ারের সাফল্যের গ্যারান্টি। অনেক সময় অস্কার জেতার পর সিনেমার বক্স অফিস কালেকশন দ্বিগুণ বা তিগুণ বৃদ্ধি পায়। অভিনেতা বা পরিচালকরা এর পরিপ্রেক্ষিতে বেশি পারিশ্রমিক পেতে শুরু করেন, যা তাদের ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা। এছাড়া প্রযোজক, পরিচালক ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত সদস্যদের জন্যও এটি একটি বড় পেশাগত সম্মান।

বিশ্বের চলচ্চিত্রে অস্কারের প্রভাব

বিশ্বের প্রায় ১০ হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত একাডেমি ভোটের মাধ্যমে বিজয়ী নির্ধারণ করে। এই ভোটাররা সিনেমা জগতের পেশাজীবী, যাদের মধ্যে অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, স্ক্রিপ্টরাইটার এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাই অস্কারের মানদণ্ড কঠোর এবং নির্বাচিত বিজয়ীরা সত্যিই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘Parasite’ ছবির সেরা ছবি জয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করে। এটি প্রথম ইংরেজি ভাষার বাইরে নির্মিত ছবি যা এই সম্মান পায়।

বিশ্বের চলচ্চিত্রে অস্কারের প্রভাব

বিতর্ক ও পরিবর্তন: অস্কার আর শুধু হলিউডের একচেটিয়া নয়

বৈচিত্র্যের অভাব, পছন্দের পক্ষপাতিত্ব এবং সংখ্যালঘুদের স্বল্প প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক। #OscarsSoWhite আন্দোলন একাডেমিকে বৈশ্বিক ও নান্দনিক বৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্য উৎসাহিত করেছে।

বাংলাদেশের অস্কার যাত্রা: স্বপ্ন ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশও অস্কারের আলোতে এসেছে ‘মাটির ময়না’ ছবির মাধ্যমে, যা বিদেশি ভাষার বিভাগে মনোনীত হয়। যদিও বাংলাদেশ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো ছবি বা শিল্পী অস্কার জিততে পারেনি, প্রতিটি মনোনয়ন দেশকে আন্তর্জাতিক সিনেমা মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করছে। এই স্বীকৃতি তরুণ নির্মাতা ও শিল্পীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

অস্কারজয়ী বিদেশি শিল্পীদের আমেরিকায় বিশেষ সুবিধা

অস্কার জয়ীদের জন্য বিশেষ সুবিধা রয়েছে, বিশেষ করে যারা নন-ইউএস বা আন্তর্জাতিক ট্যালেন্ট। অস্কার পাওয়ার পর তারা ‘O-1 ভিসা’ পেতে পারেন, যা আমেরিকায় কাজ করার জন্য এক বিশেষ ধরনের অনুমোদিত ভিসা। এই ভিসা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মেধাবীদের জন্য, যা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য অনেক দরজা খুলে দেয়। এছাড়া মার্কিন বিনোদন শিল্পে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পায়, বড় প্রোডাকশন হাউজের সঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, এবং বাণিজ্যিক চুক্তি ও পারিশ্রমিকও ভালো হয়। এই সুবিধাগুলো বিদেশি শিল্পীদের জন্য আমেরিকার বিনোদন জগতে প্রবেশ সহজ করে।

অস্কারের ইতিহাস ও গুরুত্ব
অস্কারের ইতিহাস ও গুরুত্ব

অস্কারে ফিল্ম জমা দেয়ার যোগ্যতা ও নিয়মাবলী

অস্কারে প্রতিযোগিতার জন্য ফিল্ম জমা দিতে হলে অবশ্যই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। সিনেমাটি অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমেরিকার কোনও বড় শহরে একটি নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত ৭ দিন) থিয়েটারে প্রদর্শিত হতে হবে। ফিচার ফিল্মের দৈর্ঘ্য অবশ্যই ৪০ মিনিটের বেশি হতে হবে। বিভিন্ন বিভাগ অনুযায়ী আলাদা আলাদা নিয়ম রয়েছে—যেমন বেস্ট এনিমেটেড ফিচার, ডকুমেন্টারি, আন্তর্জাতিক ফিচার ইত্যাদি।

কিভাবে নির্বাচিত হয় সেরা ছবি?

অস্কারের ভোটাররা হলেন একাডেমির প্রায় ১০ হাজার সদস্য। তারা বিভিন্ন বিভাগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ভোট দেয়। সেরা ছবি নির্বাচনের জন্য প্রথমে প্রার্থী তালিকা তৈরি হয়। সদস্যরা তাদের পছন্দমত ফিল্মের নাম দেন। প্রাথমিক ভোটে বেশি নাম পাওয়া ফিল্মগুলো ফাইনাল তালিকায় যায়। ফাইনাল ভোটে সম্পূর্ণ সদস্যরা ভোট দিয়ে সেরা ছবি বাছাই করে।

ডলবি থিয়েটারে ৯৭তম অস্কার অনুষ্ঠান চলাকালীন
ডলবি থিয়েটারে ৯৭তম অস্কার অনুষ্ঠান চলাকালীন

অস্কারের মজার ও অপ্রকাশিত তথ্য

  • অস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার জিতেছে Ben-Hur (১৯৫৯), Titanic (১৯৯৭) এবং The Lord of the Rings: The Return of the King (২০০৩)—প্রত্যেকই ১১টি অস্কার জিতেছে।
  • সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন পেয়েছেন অভিনেত্রী কাথরিন হেপবার্ন, ১২ বার।
  • ২০১২ সালে The Artist প্রথম সাদা-কালো ছবি হিসেবে সেরা ছবি জিতেছে।
  • সবচেয়ে কম বয়সে সেরা অভিনেত্রী হয়েছেন তাতুম ওলসন, মাত্র ১০ বছর বয়সে।

২০২৫ সালের ৯৭তম অস্কার: নতুন চমক ও বিজয়ীরা

২০২৫ সালের ৯৭তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠিত হয় ২ মার্চ, হলিউডের ডলবি থিয়েটারে। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন কনান ও’ব্রায়েন, প্রযোজনা করেন রাজ কাপুর ও ক্যাটি মুলান।

এই রাতে Anora ছবি আলো ছড়ায়, পাঁচটি পুরস্কার নিয়ে রাতের বড় জয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ী হলেন:

  • সেরা ছবি: Anora
  • সেরা পরিচালক: শিন বেকার (Anora)
  • সেরা অভিনেতা: এড্রিয়ান ব্রোডি (The Brutalist)
  • সেরা অভিনেত্রী: মিকি ম্যাডিসন (Anora)
  • সেরা সহকারী অভিনেতা: কিয়েরান কালকিন (A Real Pain)
  • সেরা সহকারী অভিনেত্রী: জোয়ে সালদানা (Emilia Pérez)
  • সেরা অ্যানিমেটেড ফিচার: Flow
  • সেরা ডকুমেন্টারি: No Other Land
  • সেরা মূল সুর: ড্যানিয়েল ব্লুমবার্গ (The Brutalist)
  • সেরা সিনেমাটোগ্রাফি: The Brutalist
  • সেরা শব্দ: Dune: Part Two
  • সেরা ভিজুয়াল এফেক্টস: Dune: Part Two
  • সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার: I’m Still Here
  • সেরা পোশাক ডিজাইন: পল টাজওয়েল (Wicked)
অস্কার মঞ্চে বিজয়ীদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মুহূর্ত
অস্কার মঞ্চে বিজয়ীদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মুহূর্ত

অস্কার কেবল একটি পুরস্কার নয়, এটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। এটি শিল্পীদের স্বপ্নের প্রতীক, যারা এই সম্মান অর্জন করে নিজেদের ও দেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে তুলে ধরে। প্রতিবারের মতো, প্রতিযোগিতার এই মঞ্চে বিজয়ীরা সারা বিশ্বে সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জন করে, যা তাদের জীবনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।