
সুন্দরবন পূর্ব বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য, বাগেরহাট, বাংলাদেশ। ছবি: Touhid biplob
সুন্দরবন যদি একটি বিশাল ক্যানভাস হয়, তবে তার আসল রং আর রেখাগুলো হলো তার নদীগুলো। এই নদীগুলো কেবল কোনো জলপথ নয়, বরং এরাই এই বনের হৃদস্পন্দন, রক্তধারা। গাছের সারি আর মাটির বুকে জীবন সঞ্চার করে চলেছে এই নদীগুলো। আমরা সাধারণত সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ বা ম্যানগ্রোভের কথা বলি। কিন্তু এর বহু গল্প লুকিয়ে আছে এই নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে, জোয়ার-ভাটার খেলায়। প্রতিটি নদী, প্রতিটি খাল, প্রতিটি জলধারা যেন এক একটি আলাদা গল্প বলে, যা বছরের পর বছর ধরে এই বনের বুকে বয়ে চলেছে।

ছবি: Touhid biplob
সুন্দরবনের নদীগুলো কোনো সাধারণ নদী নয়। কারন এদের তিনটি রূপ। কখনো শান্ত, আয়নার মতো নিস্তরঙ্গ, যেখানে আকাশের মেঘ আর গাছের ডাল ভেসে ওঠে পানির উপর। আবার কখনো ঝড়ো হাওয়া এলে এরা পরিণত হয় বজ্রগর্জনকারী স্রোতে, কাঠের নৌকাগুলোকে খেলনার মতো দুলিয়ে দেয়। আবার ভোরের কুয়াশায় এরা হয়ে ওঠে স্বপ্নের মতো আবছা—পানির উপর সাদা ধোঁয়ার পর্দা, আর তার ভেতর দিয়ে একাকী মাঝির দাঁড় টানার শব্দ।

কচিখালি খাল, সুন্দরবন। ছবি: Ikbal babu
সুন্দরবনের নদীগুলো জোয়ার-ভাটার তালে চলে। প্রতিদিন দু’বার করে জোয়ার আসে, আর ভাটা হয়। এই জোয়ারে নদীর পানি ৬ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত বেড়ে বনের গভীরে প্রবেশ করে। এই পানি শুধু লবণ নিয়ে আসে না। ছোট ছোট মাছ, কাঁকড়া এবং বনের নতুন প্রাণের জন্য খাবারও নিয়ে আসে। নদীগুলো যেন বনের খাদ্য ভান্ডার।

ছবি: Touhid biplob
সুন্দরবনের এই নদীগুলো যেমন জীবন দেয়, তেমনই এরা অনেক কিছু কেড়ে নেয়। নোনা পানির কারণে এখানকার মাটি বেশ নরম। জোয়ারের সময় পানি দ্রুত গতিতে আসে, আর তখন নদীগুলো তার পাড় ভেঙে দেয়। অনেক পুরোনো গ্রাম, মন্দির, এবং গাছ ভেঙে নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায়। নদীর এই পরিবর্তনশীল চরিত্র এখানকার মানুষের জীবনকে প্রায়ই অনিশ্চিত করে তোলে। এক সময় যেখানে মানুষের ঘর ছিল, আজ হয়তো সেখানে গভীর জল। নদীগুলো যেন নিজেদের ইচ্ছামতো মানচিত্র তৈরি করে।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার এই নদীর এক চিরন্তন যাত্রী। গায়ের ভেজা ডোরাকাটা লোমে সূর্যের আলো ঝিকমিক করে ওঠে, যখন সে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে সাঁতরে যায়। বনের ভেতরের ছোট ছোট খালগুলো বাঘের জন্য এক আদর্শ শিকারের জায়গা। কারণ এখানেই হরিণ ও বণ্য শূকর দল বেঁধে জল খেতে আসে। আর তখন এটাই হয়ে ওঠে বাঘের, শিকারের নাট্যমঞ্চ।

ছবি: Dr. Raju Kasambe
হাজারো জেলে, মৌয়াল আর কাঠুরে প্রতিদিন এই নদীর সাথে বাজি ধরে নৌকা নামায়। এই নদীগুলো হাজার হাজার মানুষের জীবিকার উৎস। এখানকার জেলেরা ছোট নৌকা নিয়ে নদীতে মাছ, কাঁকড়া ও চিংড়ি ধরে। এই নদীর পানিই তাদের জীবনের মূল চালিকা শক্তি। তারা জানে, নদী করুনা করলে তাদের সংসার চলবে, আর চোখ রাঙালে বিপদ ঘনীভূত হবে।
নদীগুলো শুধু মাছই দেয় না, তারা মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। সুন্দরবনের বেশিরভাগ যাতায়াত নদীপথ ধরেই হয়। পর্যটকেরা লঞ্চে করে এই নদীগুলো দিয়েই বনের ভেতরে প্রবেশ করে। নৌকার মাঝি, জেলে, পর্যটক – সবাই এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।

ছবি: Toufiq Shahab
শিবসা, পশুর, বলেশ্বর, আড়পাঙ্গাশিয়া—প্রতিটি নাম যেন একেকটি অধ্যায়। এগুলো শুধু নাম নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের ইতিহাস। নদীর তীর ঘেঁষে পাওয়া প্রাচীন বসতির নিদর্শন প্রমাণ করে যে, মানুষ বছরের পর বছর ধরে এ স্রোতের সাথে সহাবস্থানে বেঁচে এসেছে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি ঘূর্ণি যেন অজস্র গল্প জমিয়ে রেখেছে জলদস্যুর আক্রমণ থেকে শুরু করে, বাণিজ্যের কোলাহল পর্যন্ত।

ছবি: Touhid biplob
সুন্দরবন এক গভীর অরণ্য, যা পৃথিবীর জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য আর মানুষের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। আর সুন্দরবনের নদীগুলো শুধু ভৌগোলিক রেখা নয়, বরং এক চলমান জীবনের গল্প। তারা শিল্পী, তারা ধ্বংসকারী; আবার তারা জননী। তারা জন্ম দেয়, গ্রাস করে, আবার নতুন জীবন গড়ে তোলে। এই নদীগুলো এই বনের রহস্যময়তার মূল কারণ। তাদের স্রোত, তাদের ঢেউ আর তাদের নীরবতাতেই লুকিয়ে আছে এই বনের আসল সৌন্দর্য। তাই সুন্দরবনকে বুঝতে হলে, এই নদীগুলোকে বুঝতে হবে।
Metal Core Limited specializes in steel structure design, fabrication & construction. Primary & secondary steel, C/Z purlins, profiling sheets – reliable & professional.
Explore Their Expertise →